বৌদ্ধ দর্শন

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরে শাক্য বংশের এবং অভিজাত পরিবারে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। তিনি সিদ্ধার্থ নামে পরিচিত ছিলেন, পরে সাধনালপ্ত জ্ঞান লাভ করে তিনি বুদ্ধ নামে খ্যাত হন। তিনি নিজে কোন ধর্ম শাস্ত্র নীতিশাস্ত্র বা দর্শনশাস্ত্র রচনা করেননি, জনসাধারণের মধ্যে তার অভিজ্ঞতা ও সাধনা লব্ধ জ্ঞান মুখে মুখে প্রচার করেছেন। তার শিষ্য গণ তার উপদেশগুলোকে একত্রিত করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন এবং এই গ্রন্থের নাম হলো ত্রিপিটক , যেটি পালি ভাষায় রচিত।

ত্রিপিটক

ত্রিপিটক তিনটি পিটকের সমাহার যথা সুত্তপিটক, বিনয়পিটক , অভিধম্মপিটক।

সুত্ত পিটক – বুদ্ধদেবের জ্ঞান উপদেশ গুলির আলোচনা করা হয়েছে।
বিনয় পিটক – বৌদ্ধ শিষ্যদের জন্য পালনীয়কর্তব্যগুলিকে আলোচনা করা হয়েছে।
অভিধম্ম পিটক – বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

জ্ঞানতত্ত্ব

বৌদ্ধ দর্শনে অজ্ঞানতাকে দুঃখের মূল কারণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ বলেছেন যে জ্ঞান আমাদের ইপসিত বস্তুকে লাভ করতে সহায়তা করে তাকে বলা হয় প্রকৃত জ্ঞান। এই প্রকৃত জ্ঞান লাভের দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে প্রত্যক্ষ ও অনুমান।

প্রত্যক্ষ

বৌদ্ধ দর্শনে দু প্রকার প্রত্যক্ষের উল্লেখ করা হয়েছে সবিকল্প ও নির্বিকল্প।

সবিকল্প প্রত্যক্ষ
কোন বস্তুর নাম ,জাতি বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিকল্প যুক্ত করে জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়াকে বলা হয় সবিকল্প প্রত্যক্ষ।
যেমন আগুনকে আগুন বলে জানার জন্য তার নাম, জাতি ইত্যাদি জানতে হয়।

নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ
যে প্রত্যক্ষে বস্তুর জ্ঞান হয় কিন্তু তার প্রকার বা নাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান হয় না অর্থাৎ নাম, জাতি ইত্যাদি বিকল্প ছাড়াই শুদ্ধ জ্ঞান যে পদ্ধতিতে পাওয়া যায় তাকে বলা হয় নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ।
যেমন আগুনের স্বরূপ হল দহন শক্তি। আগুনকে আগুন নামে না জেনে যদি তাকে বৃষ্টি নামে জানি তবু ও আগুনের দহন শক্তি থাকবে।

বৌদ্ধ দর্শনে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকেই প্রকৃত ও শুদ্ধ জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াহয়েছে। অর্থাৎ সবিকল্প জ্ঞান হলো মূর্ত ও নির্বিকল্প জ্ঞান হল বিমুর্ত।
ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে কোন বিষয় বা বস্তু কতখানি প্রকাশিত হয় সে বিষয়ে মতভেদ ঘটায় পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দর্শনের চারটি শাখা গড়ে উঠেছে বৈভাষিক,সৌতান্ত্রিক যোগাচার ও মাধ্যমিক সম্প্রদায়। এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশ্লেষণের মধ্যে বিস্তারিতভাবে প্রবেশ না করে ,সাধারণভাবে উপরিউক্ত আলোচিত দুই প্রকারের প্রত্যক্ষের উল্লেখ করা হয়েছে।

অনুমান

অনুমানকেও বৌদ্ধ দর্শনের জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি হিসেবে স্বীকার করা হয় কারণ মনের সাহায্যে জ্ঞান কিভাবে সংগৃহীত হয় তা বৌদ্ধ দর্শনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই দর্শন মতে মনের ভালো ও মন্দ দুটি গুণই বর্তমান। আবার ভালো-মন্দ উভয় প্রকার জ্ঞানই কিছু কিছু সার্বজনীন এবং কিছু কিছু বিশেষধর্মী।
মনের সার্বজনীন ভালো গুণগুলি হল স্পর্শ, বেদনা, সংজ্ঞা, চেতনা, একাগ্রতা,জীবিতিন্দ্রিয় ও মনোসিকার।
মনের মন্দ গুনগুলি হল মোহ, নির্লজ্জতা, অনুতাপের অভাব, মনোযোগের অভাব। এই ছাড়াও বিশেষ মন্দ গুণ হিসেবে ভ্রান্তি ও লোভের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বৌদ্ধ জ্ঞানতত্ত্ব অনুযায়ী জ্ঞাতার মন ইন্দ্রিয় এবং বস্তুজগত কিভাবে পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত হয় তা ব্যাখ্যা করার জন্য বৌদ্ধ দর্শনে তিনটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ আছে।

  1. কোন বস্তু যখন ইন্দ্রিয় উদ্দীপনার মাধ্যমে মনের সামনে উপস্থিত হয় তখন জ্ঞাতার অন্তরে একটি কম্পন শুরু হয়।
  2. এই কম্পনের ফলে মনের মধ্যে অবস্থিত সঞ্চিত অভিজ্ঞতা গুলির সঙ্গে নতুন উদ্দীপনার মিলন ঘটে এবং মন সেগুলিকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে এবং মন শুদ্ধ রূপটিকে চিনতে পারে।
  3. অভিজ্ঞতার শুদ্ধ রূপটি আত্তীকরণ হয়, এইভাবে জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয় ,মন ও বস্তুজগত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়।

নীতিবিদ্যা

পঞ্চশীল

  1.  মিথ্যে কথা না বলা।
  2. চুরি না করা।
  3. হিংসা না করা।
  4. বিকৃত যৌন প্রবৃত্তি বা কু- যৌন প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
  5. কোন নেশা জাত বস্তু গ্রহণ না করা।

আর্য সত্য

  1. সবই দুঃখময়
  2. দুঃখের কারণ আছে
  3. দুঃখ নিরোধ সম্ভব
  4. দুঃখ নিরোধের সুনির্দিষ্ট উপায় আছে

অষ্টাঙ্গিক মার্গ

1.সম্যক দৃষ্টি – বৌদ্ধ দর্শনের চারটি আর্য সত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানী হল সম্মুখ দৃষ্টি।
2.সম্যক সংকল্প – সম্যক দৃষ্টির দরুন মানুষের জ্ঞান উপলব্ধি করেছে তার ভিত্তিতে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে।
3.সম্যক বাক – মিথ্যা ভাষণ, অপ্রিয় কথন, পরনিন্দা,ত্যাগ করাই বৌদ্ধ দর্শনে সম্যকবাক।
4.সম্যক কর্মান্ত – অহিংসা, অচৌর্য্য, অবৈধ ইন্দ্রিয়সম্ভোগ থেকে বিরতি কে সম্যক কর্মান্ত বলা হয়।
5.সম্যক আজীব – সৎ উপায়ে জীবিকা অর্জনকে বলা হয়।
6.সম্যক ব্যায়াম – বৌদ্ধ দর্শনে এটিকে মানসিক পর্যায়ে অনুশীলনের বোঝানো হয়েছে। তার অর্থাৎ ব্যক্তির কে পুরাতন বা নতুন সব রকম অসৎ চিন্তাকে মন থেকে দূরে রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
7.সম্যক স্মৃতি – দেহ, মন,মানসিক অবস্থা সবই অনিত্য। এই সকল থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলে জীবনের দুঃখ মোচন হবে।
8.সম্যক সমাধি – উপরিউক্ত ৭টি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে মানুষ যে অবস্থা লাভ করে তা সম্যক সমাধি। এই অবস্থায় ব্যক্তি নির্বাণ লাভ করে।

অধিবিদ্যা

ক্ষণিকবাদ

ক্ষণিকবাদ খুব অল্প সময়ের জন্য বোঝায়, প্রায়ই “মুহূর্ত” হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ক্ষণিকবাদ দাবি করে যে , সমস্ত যৌগিক ঘটনা অস্থায়ী এবং শুধুমাত্র ক্ষণিকের জন্য বিদ্যমান। এর মানে হল মানসিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতা সহ অভূতপূর্ব জগতের সবকিছুই ক্রমাগতভাবে উত্থিত হয় এবং পতিত হয়ে যায়। ক্ষণিকবাদে সৎ গুন্ ও অসৎ গুন্ বর্তমান। উদহারণ হিসাবে বলা যায়…একটি ধানের বীজ যদি ঘরের মধ্যে রেখে দেওয়া হয় তাহলে তার কোনো ফল প্রদানের ক্ষমতা থাকে না সুতরাং বলা যায় এখানে অসৎ গুন বর্তমান কিন্তু যদি সেই ধানে বীজ টিকে উর্বর জমিতে রোপন করা হয় এবং যত্ন নেওয়া হয় তাহলে সেটি ফল প্রদান করবে,এক্ষেত্রে বীজ টির মধ্যে সৎ গুনের আবির্ভাব ঘটবে।

অনিত্যবাদ

অনিত্য হল একটি সংস্কৃত শব্দ, এবং anicca হল এর পালি ভাষার সমতুল্য, উভয়ের অর্থই অস্থিরতা বা ক্ষণস্থায়ী।
বৌদ্ধ শিক্ষায়, অনিত্য/অনিক্কা হল দুখ (কষ্ট) এবং অনাত্মা (অ-আত্ম) পাশাপাশি অস্তিত্বের তিনটি চিহ্নের একটি।
এটি অস্থায়ী, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং কোনো স্থায়ী সারাংশ বা স্থায়ী পদার্থ বর্জিত হওয়া সমস্ত ঘটনার মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়।

অন্তর্দৃষ্টি (বিপাসনা) এবং প্রজ্ঞা বিকাশের ক্ষেত্রে অনিত্য/অনিক্কা নিয়ে চিন্তা করা একটি মূল অনুশীলন, কারণ এটি অনুশীলনকারীদের স্থায়ীত্বের বিভ্রম থেকে দেখতে এবং প্রবাহ ও পরিবর্তনের বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করতে উত্সাহিত করে।

উদহারণ হিসাবে বলা যায়…আনন্দ বা দুঃখের অনুভূতি কল্পনা কর। এই আবেগগুলি উত্থিত হয়, তীব্রতা পরিবর্তন করে এবং অবশেষে হ্রাস পায়। তারা স্থির নয়; তারা আসে এবং যায়, মানসিক অবস্থার অস্থিরতা প্রদর্শন করে।

প্রতিত্যসমুত্পাদ

“প্রতিত্যসমুত্পাদ” (সংস্কৃত) বা “Paṭicca-samuppād” (পালি) হল বৌদ্ধ দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা, প্রায়ই “নির্ভরশীল উৎপত্তি” বা “নির্ভরশীল উদ্ভব” হিসাবে অনুবাদ করা হয়। এটি সমস্ত ঘটনার আন্তঃনির্ভরশীল প্রকৃতি বর্ণনা করে এবং ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে সমস্ত জিনিস একাধিক কারণ এবং অবস্থার উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *