ন্যায় দর্শন

ভূমিকা

যুক্তি তর্কের দ্বারা কোন বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াকে বা সংশয়তিত ভাবে কোন সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ন্যায়। ন্যায়দর্শনের উদ্দেশ্য হল কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য যুক্তিসিদ্ধ চিন্তা প্রক্রিয়া কিরূপ হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে নির্দেশ দান করা।
এই ন্যায়দর্শনের প্রবর্তক হিসাবে ঋষি গৌতম এর নাম উল্লেখ করা হয় তিনি অক্ষপাদ নামেও পরিচিত। আধুনিক চিন্তাবিদগণ ন্যায়দর্শনকে যুক্তি নির্ভর বস্তুবাদ (logical realism)বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
ভারতীয় ন্যায়দর্শনের দুটি শাখা বর্তমান প্রাচীন ন্যায় এবং নব্য ন্যায়।

ন্যায়দর্শন মতে আত্মা একটি অসাধারণ অভৌতিক বস্তু। নৈয়ায়িকদের মতে জ্ঞান, ইচ্ছা, হিংসা, সুখ, দুঃখ, ধর্ম ও অধর্ম এগুলি সব ই আত্মার গুণ। তারা বলেছেন এতগুলি গুণ একত্রে কোন জড় বস্তুর মধ্যে থাকতে পারে না তাই এমন একটি অজড় বস্তু বর্তমান যার মধ্যে এইসব গুণ থাকে আর সেই অজড় বস্তুকে বলা হয় আত্মা।
ন্যায়দর্শনে দু প্রকার আত্মার কথা বলা হয়েছে জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। জীবাত্মা অসংখ্য এক একটি দেহে এক একটি আত্মা বর্তমান কারণ প্রতি ব্যক্তির কর্ম জ্ঞান ইচ্ছা ইত্যাদি পৃথক । অন্যদিকে ঈশ্বর হচ্ছেন নিত্য , শাশ্বত, আত্মা। তিনিই পরমাত্মা , জগতের সৃষ্টি রক্ষণ এবং সংহারকর্তা।
ন্যায়দর্শন অনুযায়ী জীবাত্মা মন ও দেহ থেকে পৃথক কিন্তু মন ও দেহের সংযোগে জীবাত্মার মধ্যে সুখ দুঃখ ইত্যাদি গুণের উদ্ভব হয় এই কারণে শরীর ধারণ করলেই দুঃখ ভোগ করতে হয়। তারা বলেছেন অজ্ঞানতাই দুঃখের মূল কারণ তাই দুঃখ দূর করতে হলে প্রকৃত জ্ঞানের প্রয়োজন। পরমাত্মা জ্ঞানী ও প্রকৃত। এই নিত্য জ্ঞান ,পরমাত্মার জ্ঞানের মাধ্যমে মোক্ষলাভ করাই হবে জীবনের মূল লক্ষ্য।

ন্যায়দর্শন অনুযায়ী জ্ঞান দু প্রকার প্রমা ও অপ্রমা।
ন্যায় দার্শনিকগণ জ্ঞাতা ও জ্ঞেও বস্তুর পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। পদার্থের উপস্থিতিতে পদার্থের জ্ঞানকে বলে অনুভব আর অনুভব যখন বিষয়ে রূপান্তরিত হয় তখন তাকে বলে প্রমা। এই মতানুযায়ী প্রকৃত জ্ঞান বা প্রমা চারটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আহরণ করা যায় এই চারটি প্রক্রিয়া হল –

ন্যায় দার্শনিকদের মতে প্রত্যক্ষই সকল প্রকার জ্ঞান আহরণের মূল পদ্ধতি জ্ঞানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে যে কোন ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘাটলে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা যায় এই দর্শন মতে মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয় পাঁচটি নয় ছয়টি চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা , ত্বক এবং মন। এদের মধ্যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বককে বলা হয় বহিরেন্দ্রিয় এবং মনকে বলেছেন অন্তরিন্দ্রিয়। পাঁচটি বহিরিন্দ্রিয় এর সঙ্গে বস্তুর সন্নিকর্ষের ফলে যে প্রত্যক্ষ হয় তাকে বলা হয় লৌকিক প্রত্যক্ষ বা বাহ্য প্রত্যক্ষ। অন্যদিকে মনের মাধ্যমে যে প্রত্যক্ষ হয় তাকে বলা হয় অলৌকিক প্রত্যক্ষ, যার অপর নাম মানস প্রত্যক্ষ।

লৌকিক প্রত্যক্ষের তিনটি স্তর নির্বিকল্প সবিকল্প ও প্রত্যভিজ্ঞা । নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ হলো বস্তুর গুণহীন সংবেদন। সবিকল্প প্রত্যক্ষ হল বস্তুর গুণ যুক্ত প্রত্যক্ষ।প্রত্যভিজ্ঞা হল কোন বস্তুকে পূর্বে জানা আছে এই হিসাবে প্রত্যক্ষ করাকে।
অলৌকিক বা মানস প্রত্যক্ষকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যথা সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ, জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ ও যোগজ প্রত্যক্ষ।

সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ

কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ করার সময় সেই বস্তু বা ব্যক্তি যে শ্রেণীর বা জাতির অন্তর্গত সেই শ্রেণীর বা জাতির অন্তর্গত সকল বস্তু বা ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ করার নাম সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমরা যখন কোন একটি পাখি দেখি তখন সেই পাখিটি দেখার সাথে সাথে সেই বৈশিষ্ট্য যুক্ত অন্যান্য পাখি গুলির বৈশিষ্ট্য আমাদের মনে আসে।

জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ

জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার স্থানান্তর হয় অর্থাৎ যে ইন্দ্রিয় দিয়ে যে বস্তু প্রত্যক্ষ করা যায় না মানসিক পর্যায়ে সেই ইন্দ্রিয় দিয়ে সেই বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা হলো জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ। যেমন যখন এক টুকরো বরফ চোখে দেখে বলা হয় যে সেটি হিম শীতল বরফের টুকরো তখন এই জাতীয় জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ হয়।

যোগজ প্রত্যক্ষ

ভূত ভবিষ্যৎ সুখ্য ও প্রচ্ছন্ন বিষয়ের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতাকে যোগজ প্রত্যক্ষ বলা হয়। যেমন যোগ্য অভ্যাস এর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জীবনে পূর্ণতা লাভ করলে এই জাতীয় প্রত্যক্ষ হওয়া সম্ভব।

অনুমান হল কোন জ্ঞান নির্ভর অন্য জ্ঞান কিভাবে যুক্তির সাহায্যে অনুমান করা হয় সেই সম্পর্কে ন্যায় দার্শনিকগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তারা দু প্রকারের প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান
যখন ব্যক্তি নিজের জ্ঞানের জন্য অনুমান করে তখন তাকে বলা হয় স্বার্থানুমান ,অন্যদিকে অনুমান কারী ব্যক্তি যখন অপরের কাছে কোন বিষয়বস্তু উপস্থাপনের জন্য অনুমান করে তখন তাকে বলা হয় পরার্থানুমান ।

পূর্ব পরিচিত কোন বস্তুর সঙ্গে অপরিচিত বস্তুর সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে নতুন বস্তুটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে উপমান। যেমন কুবো পাখি দেখতে অনেকটা কোকিলের মত সুতরাং যে ব্যক্তি কখনো কুবো পাখি দেখেনি কিন্তু কোকিল পাখি দেখেছে সেই ব্যক্তি কোকিল দেখার পূর্বজ্ঞানের সঙ্গে উপমানের পরিপ্রেক্ষিতে কুবো পাখি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারবে।

অন্যের উচ্চারিত শব্দ বাক্য থেকে যে জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে বলা হয় শাব্দিক জ্ঞান। যে ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য এরকম ব্যক্তির উচ্চারিত শব্দ বা বাক্যই প্রকৃত জ্ঞান লাভের উপায়। ন্যায়দর্শনে সত্যবাদী, সত্যদর্শী এবং যিনি বাক্যের প্রকৃত অর্থ জানেন তার বাক্যকেই আত্য বাক্য বলা হয় এবং সেই ব্যক্তিকে আত্য পুরুষ বলা হয়ে থাকে এই আত্য বাক্যই প্রকৃত জ্ঞানের উৎস।

এই দর্শনে বলা হয়েছে বারটি বিষয়ে জ্ঞান মানুষের পক্ষে প্রয়োজন সেগুলি হল আত্মা ,শরীর, ইন্দ্রিয়,বুদ্ধি,মন, প্রবৃত্তি, দোষ,প্রেত্যভাব, ফল, অর্থ,দুঃখ ও অপবর্গ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *