শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের উপর সামাজিকীকরণের প্রভাব

সামাজিকীকরণ কি

মানব সমাজের অস্তিত্ব সমাজের মনো জগতের মধ্যে বর্তমান।সমাজের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্ক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। নবজাতক শিশুর আচরণ মূলত সহজাত প্রবৃত্তি, শিক্ষার প্রভাব বর্জিত শিশুর এই আচরণ গুলিকে সমাজানুগ সাংস্কৃতিক প্রভাবী করার জন্য প্রচলিত বংশানুক্রামির রীতিনীতি সমন্বিত প্রচেষ্টাকে সামাজিকীকরণ বলে।
অর্থাৎ বলা যেতে পারে সামাজিক জীবন হিসেবে মানুষ শুধুমাত্র মর্যাদার অধিকারীহয় না, মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত কর্তব্য গুলি সম্পর্কে সচেতন হয়। জন্মের পর থেকে মানুষ শিশু যে প্রক্রিয়ার দ্বারা এই সমস্ত সামাজিক কর্তব্য পালন করার ক্ষমতা বা কৌশল আয়ত্ত করে তাকেই সামাজিকীকরণ বলা হয়।
J.S.ROSS এর মতে, “socialization is the development of we feeling in associates and the growth in their capacity and will to act together.”
এ প্রসঙ্গে বলা যায়সামাজিকীকরণ ও সামাজিকতা দুটি বিষয় এক নয় আলাদা।সামাজিকীকরণ বলতে একটি প্রণালী কে বোঝায় অপরদিকে সামাজিকতা হলো ব্যক্তির একটি বিশেষ গুণঅর্থাৎঅপরের সঙ্গে মেলামেশা করার এবং সহজ স্বচ্ছন্দভাবে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতাকে বোঝায়।

PROCESS OF SOCIALIZATION

সমাজবিজ্ঞানী রবার্টসন তার সোসিওলজি শীর্ষক গ্রন্থে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার চারটি প্রকারভেদ এর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।নিম্নে সেগুলি আলোচনা করা হলো।

PRIMARY SOCIALIZATION

প্রাথমিক সামাজিকীকরণের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক নিয়ম নীতির অন্তরিতকরণ। সামাজিক নিয়ম-নীতির অন্তরিতকরণ বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সামাজিক নিয়ম নীতি সমূহ ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের অঙ্গীভূত হয়ে যায়।একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর নৈতিক অনৈতিক, বাঞ্ছিত অবাঞ্ছিত, ভালো-মন্দ প্রভৃতি বিষয়ে কোন ধারণা তাদের মধ্যে থাকে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ,আচার ব্যবহারের ঠিক ভুল সম্পর্কিত নিয়ম নীতি তারা সামাজিকীকরণপ্রক্রিয়ার উপাদান সমূহের মাধ্যমে আয়ত্ত করে।

ANTICIPATORY SOCIALIZATION

প্রত্যাশা মূলক সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা এমন কোন গোষ্ঠীর জীবনধারায় ব্যক্তি নিজের সামাজিকীকরণ সম্পাদন করে; যে গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার বাসনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে বর্তমান এই ধরনের সামাজিকীকরণ প্রত্যাশামূলক সামাজিকীকরণ হিসেবে পরিচিত যেমন কোন একজন ব্যক্তির শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে সেক্ষেত্রে সে শিক্ষকের বিভিন্ন আচার-আচরণ আয়ত্ত করায় আত্মনিয়োগ করতে পারে। আবার কোন এক ব্যক্তির সেনাবাহিনীতে যোগদানের অভিপ্রায় থাকলে সেই ব্যক্তি সৈনিক ব্যক্তির আচার-আচরণ আয়ত্ত করায় আত্মনিয়োগ করতে পারে।

DEVELOPMENTAL SOCIALIZATION

এই ধরনের সামাজিকী করণ প্রাথমিক সামাজিকীকরণের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক সামাজিকীকরণেরসময় যখন একটি শিশু বা ব্যক্তি সমাজের রীতিনীতি প্রথা সেগুলিকে আয়ত্তী করণ করছে অথবা কোনটি নৈতিক কোনটি বঞ্চিত আবাঞ্ছিত কোনটি ভালোমন্দ সেই সম্বন্ধে আয়ত্তীকরণ করছে সেগুলোই যখন নতুন পরিস্থিতি মধ্য দিয়ে মানুষ অগ্রসর হয় তখন সেই সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এইভাবে অর্জিত জ্ঞান বুদ্ধি ও দক্ষতার ভিত্তিতে উন্নয়নমূলক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

ACCORDING TO ROBERTSON ” Developmental socialization builds on already acquired skills and knowledge as the adult progresses through new situations…. New learning is added to and blended with old in a relatively smooth and continuous process of development.”

RE-SOCIALIZATION

সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের ভূমিকার পরিবর্তন গোষ্ঠীর ভিতরে যেমন ঘটে তেমনি নতুন গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবেও ঘটে তার ফলে ইতিমধ্যে প্রাপ্ত শিক্ষাদীক্ষার ধারা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সরে আছে এবং প্রতি কল্প নিয়ম-নীতি বা অভিজ্ঞতা প্রতিস্থাপিতহয়। এই প্রক্রিয়া পূর্ণ সামাজিকীকরণ হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ যখন সামাজিক ভূমিকার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে তখনই পূর্ণ সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হয় | উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অবস্থা নিয়তির প্রতিকূল পরিহাসে কোন অবিবাহিত, বিবাহিত বা বিধবা তরুণী পতিতালয়ে প্রক্ষিপ্ত হয়ে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করলেসংশ্লিষ্ট অভাগিনীর পূর্ণ সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হয়।

DIFFERENT COMPONENTS OF SOCIALIZATION

IMITATION

এক ব্যক্তি যখন অপর একজনের কাজকর্ম আচার-আচরণকে নকল করে তখন তাকে অনুকরণ বলে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে কোন শিশু তার ঠাকুমার চশমা পড়ে বা ঠাকুমার হাঁটাচলার ভঙ্গিতে হাঁটার চেষ্টা করে অনুকরণের মাধ্যমে।

SUGGESTION

অভিভাবন হলো এক ধরনের যোগাযোগ প্রক্রিয়া এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন প্রস্তাব বা তথ্যাদি অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়াহয় এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য অপরজনদৃঢ়প্রত্যায়ের সঙ্গে স্বীকার ও গ্রহণ করে থাকে।শিশুদের মধ্যে যুক্তি তর্কের জ্ঞান না থাকার ধরণ সভাপতি তারা এই অভিভাবন প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু বয়স, চিন্তা শক্তি ও জ্ঞান বুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা ও ক্ষমতা হ্রাস পায়।এই কারণে অভিভাবন প্রক্রিয়া বয়স্কদের ক্ষেত্রে সহজে কার্যকরী হয় না কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে হয়। কিন্তু এ কথা উল্লেখ করা আবশ্যক যে বিভিন্ন সমাজের শিশুর ক্ষেত্রে এবং একই সমাজের সকল শিশুর ক্ষেত্রে পরিবহন প্রক্রিয়ার ক্রিয়া, অভিন্ন রকমের হয় না।

IDENTIFICATION

শৈশব অবস্থায় শিশু সচেতনভাবে সবকিছু আচরণ করে না, এই সময় শিশু তার জৈব অস্তিত্বের সঙ্গে তার চারপাশের পরিবেশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশ ঘটে এবং আস্তে আস্তে কোন জিনিস তার প্রয়োজন পূরণে লাগবে সেই সমস্ত জিনিস শিশুর অঙ্গীভূতকরণের বিষয়ে পরিণত হয়ে থাকে। এইভাবে শিশু অঙ্গীভূত করে নেয় বিভিন্ন খেলার জিনিস ছবি ছড়ার বই প্রভৃতি যা তার বিনোদনের কাজে লাগবে।

LANGUAGE

ভাষা হল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম শৈশবের শুরুতে শিশু কিছু এলোমেলো শব্দ সৃষ্টি করে তারপরে সে মাতৃভাষা ধীরে ধীরেআয়ত্ত করতে থাকে। বস্তুত ভাষা শৈশব থেকেই ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে।

Bidyabhushan and Sachdev commented on this, “Language is the medium of social intercourse. It is the means of cultural transmission.”

FAMILY AND SOCIALIZATION

সামাজিকীকরণের প্রথম সূত্রপাত ঘটে পরিবারে। পরিবার হল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংগঠন। কোন প্রতিষ্ঠানে পরিবারের মত শিশুর দেহমনকে সুগঠিত করে বিকশিত করে তুলতে পারে না নিম্নে পরিবারের কিছু ভূমিকা আলোচনা করা হলো।

  1. পরিবারের মাধ্যমে একটি শিশু নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিক আদর্শ, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণ আয়ত্ত করে এক কথায় শিশুর সামাজিকীকরণ সম্পন্ন হয়।
  2. সামাজিকীকরণের ফলে সামাজিক ঐতিহ্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয় আর এই সঞ্চালনের দায়িত্ব অবশ্যই পরিবারের।পরিবারের সদস্যদের আমরা বোধের মাধ্যমে পারিবারিক ধ্যান-ধারণা ও মনোভাব উত্তর পুরুষের মধ্যে সহজে সঞ্চালিতহয়।
  3. বর্তমানে নগরায়ন,শিল্পায়ন,পশ্চিমায়ন ও আধুনিকিকীকরণের যুগে যৌথ পরিবার ভেঙে অনু পরিবারে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে শিশুর মানসিকতা সামাজিকীকরণের ধারা নির্ভর করে সম্পূর্ণ অভিভাবকের ওপরে। কখনো বাবা-মায়ের মনোযোগের অভাবে ছেলেমেয়েরা বিপদে পরিচালিত হচ্ছে বা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিতহচ্ছে। আবার অত্যাধিক মনোযোগের ধরন তারা সংগতিবিধান করতে পারছে না।
  4. অভিভাবকদের কঠোর পরিচালক সুলভ মনোভাব যেমন ক্ষতিকর তেমনি পূর্ণ অনুমতি প্রদানকারী মনোভাব ও ছেলেমেয়েদের সুচরিত্র গঠনের পক্ষে সহায়ক নয়। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণ মূলক মনোভাব কি উপযুক্ত বলে মনে করা হয় এক্ষেত্রে শিশুরা নিজেদের পরাধীন মনে করে না অথচ তাদের উপর নিয়ন্ত্রিত নির্দেশনা থাকে। পরিবারকে ‘সভ্যতার টার্নিং পয়েন্ট’ বলা যেতে পারে।

SCHOOL AND SOCIALIZATION

সামাজিকীকরণের শুরু পরিবারের মধ্য দিয়ে হলেও পরবর্তীকালে সামাজিকীকরণের প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে বিদ্যালয়। নিম্নে বিদ্যালয়ের কিছু ভূমিকা আলোচনা করা হলো –

  1. পরিবারে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব হয় না তা বিদ্যালয়ের পরিবেশে লাভ করা যায়।
  2. শিশু যখন বিদ্যালয় আছে তখন তার অনেক আচরণ ব্যক্তি জীবন বিকাশের অনুকূল থাকে না। পরিবার থেকে প্রাপ্ত কু অভ্যাস অবাঞ্ছিত আচরণ অভিজ্ঞতার সংশোধনের দায়িত্ব নিতে হয় বিদ্যালয়কে।
  3. সামাজিক রীতিনীতি আদর্শ সংরক্ষণে বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সামাজিক রীতিনীতি এবং আদর্শ বিদ্যালয়ের দ্বারা তা শিশুর মধ্যে সঞ্চালিত হয়ে থাকে। সুতরাং বলা যেতে পারে সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের এবং সঞ্চালনের দায়িত্ব বিদ্যালয়ের।
  4. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে একটি শিশু পরিবর্তনশীল সমাজের আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনীতি শিল্পকলা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী ইত্যাদি সঙ্গে পরিচিত হয় অর্থাৎ বিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধের আত্তীকরণ ঘটে শিশুর মধ্যে।
  5. বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে প্রক্ষোভ মূলক সংগতিবিধান ঘটে থাকে।

PEER’S GROUP AND SOCIALIZATION

সমগোষ্ঠী কিভাবে সামাজিকীকরণকে প্রভাবিত করে তা এখানে আলোচনা করা হলো।

  1. কিশোর কিশোরীরা তাদের সমবয়সীদের কাছ থেকে প্রায়ই বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা খোঁজে যা তাদের আত্মপরিচয় গঠনের অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
  2. সমবয়সীদের সঙ্গে একসাথে মিথস্ক্রিয়া করার দরুন তাদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে যেমন সহযোগিতা, সহমর্মিতা, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি।
  3. সমবয়সী গোষ্ঠীর দ্বারা মানসিক সমর্থন কিশোর কিশোরীদের মধ্যে আত্মীয়তা এবং বন্ধুত্বের অনুভূতি প্রদান করে। অর্থাৎ সমবয়সী সম্পর্ক মানসিক স্থিতিস্থাপকতা এবং সুস্থতায় অবদান রাখতে পারে।
  4. সমবয়সী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার দ্বারা কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রকার প্রভাব পড়তে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *